॥ সামছুল আরেফীন॥
দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকে আছে। কোনোভাবেই ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানো যাচ্ছে না। আসছে না বিদেশী বিনিয়োগও। নতুন বিনিয়োগ না হওয়ায় কমে আসছে বিদ্যমান বিনিয়োগও। ফলস্বরূপ নতুন কর্মসংস্থান তো হচ্ছেই না, কর্মহীন হয়ে পড়ছেন কর্মজীবীরাও। দীর্ঘ হচ্ছে বেকার মানুষের মিছিল। হতাশা ঘিরে ধরছে তরুণ প্রজন্মকে। বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, শিল্পে গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় এবং এখনো ঠিকমতো সংযোগ না পাওয়ায় অনেকে বিনিয়োগ প্রকল্প হাতে নিয়েও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গেছেন। এর সঙ্গে আছে অনুন্নত অবকাঠামো। আর বেশি ভোগাচ্ছে ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার। এ ব্যাপারে এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ স্পষ্টতই বলেছেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কেন হচ্ছে না, তার সবচেয়ে বড় কারণ ব্যাংকঋণের চড়া সুদের হার। এটাকে যদি এক অঙ্কের ঘরে রাখা যায় তাহলে বিনিয়োগ এমনিতেই বেড়ে যাবে। এর সঙ্গে লাগবে শিল্পে বিদ্যুত সংযোগ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং উইং কর্তৃক প্রাক্কলিত প্রাথমিক হিসেবে বলা হয়েছে, শিল্পখাতের বৃহৎ ও মাঝারি উপখাতে গত অর্থবছরের চেয়ে এ বছর প্রবৃদ্ধি কমেছে ১ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ উপখাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ, যা গত অর্থবছরে ছিল ৮ দশমিক ৮১ শতাংশ। আর হালকা শিল্প উপখাতে প্রবৃদ্ধির হার কমেছে ২ দশমিক ২১ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ উপখাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, যা গত অর্থবছরে ছিল ৮ দশমিক ৮১ শতাংশ।
উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, দেশে প্রতি বছর ১৮ থেকে ২০ লাখ তরুণ-তরুণী কর্মসংস্থানের জন্য তৈরি হয়। গত এক বছরের অস্থিরতায় তাদের কাজ পাওয়ার সুযোগ তো হয়ইনি, উল্টো কর্মহীন হয়ে পড়েছেন ১০ লাখ কর্মজীবী। গত ছয় মাসে কেবল তৈরি পোশাক শিল্পখাতে চাকরিচ্যুত হয়েছেন লক্ষাধিক শ্রমিক। এ সময় দেশে নতুন করে কোনো কারখানাই গড়ে ওঠেনি। চালু হয়নি বন্ধ থাকা কয়েক হাজার কারখানার একটিও।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের (বিওআই) তথ্যে দেখা যায়, ২০১৩ সালে দেশে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকে বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়েছে ৪২ হাজার ৪৮৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকার। নিবন্ধিত শিল্প প্রকল্পের সংখ্যা এক হাজার ১৯৭টি। ২০১২ সালে এক হাজার ৬৫৫টি শিল্প প্রকল্পে স্থানীয় বিনিয়োগ নিবন্ধনের পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ৭৮ কোটি ছয় লাখ টাকার। অর্থাৎ বিনিয়োগ নিবন্ধন কমেছে ১৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। ২০১৪ সালের প্রথম চার মাসে বিনিয়োগ নিবন্ধনের হার আগের বছরের চেয়ে ৪০ শতাংশ কমেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
বিনিয়োগ বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বিদেশী বিনিয়োগ নিবন্ধন মারাত্মকভাবে কমে গেছে। এ সময় ছয়টি শতভাগ বিদেশী এবং ১৫টি যৌথ বিনিয়োগ প্রকল্প নিবন্ধিত হয়। নিবন্ধনের পরিমাণ ছিল মাত্র ৭৮৭ কোটি টাকা। অথচ আগের প্রান্তিকে ২১টি শিল্প প্রকল্পে বিদেশী বিনিয়োগ নিবন্ধনের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৭০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। বিওআইয়ের তথ্য থেকে দেখা যায়, আগের বছরের চেয়ে ২০১৩ সালে শিল্প প্রকল্পের প্রস্তাব বেশ কমেছে। ২০১২ সালে যেখানে এক হাজার ৮৫৫টি প্রকল্প নিবন্ধিত হয়েছিল, গত বছর তা নেমে আসে এক হাজার ৩৭৮টিতে।
জানা যায়, দেশের মোট কর্মসংস্থানের অন্তত ৩ শতাংশ মানুষ জড়িয়ে আছে নির্মাণ খাতের সাথে। গত তিন বছরে এ খাতে নতুন বিনিয়োগ তো হয়ইনি, আটকে আছে ৯৬ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। ত্রিশ হাজারের বেশি নির্মিত ফ্যাট বিক্রি না হওয়ায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে পুরো শিল্প সেক্টরে। এর প্রভাবে মন্দাবস্থা বিরাজ করছে রি-রোলিং, সিমেন্ট, ব্রিকফিল্ডসহ অনেক উপখাতেই। সুসংবাদ নেই বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও। সরকারের উদাসীনতা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বৈরী সম্পর্কের কারণে বিদেশে কর্মী প্রেরণ প্রায় বন্ধই হয়ে আছে। কৃষি, পোলট্রি, পাট, চা, চামড়ার মতো শিল্পগুলোতেও চলছে নানাবিধ হতাশা।
ফেডারেশন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, দেশে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে একজন শিল্পোদ্যোক্তার জন্য এটি কোনোভাবেই সুবিধাজনক নয়। গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কট তো আছেই, রাজনৈতিক পরিস্থিতিও বিবেচনার বিষয়। এমতাবস্থায় বিদ্যমান বিনিয়োগ নিয়ে উদ্যোক্তারা যখন চরম বিপাকে তখন নতুন বিনিয়োগ নিয়ে ভাববার সময় কোথায়? বিনিয়োগ না হলে উৎপাদন হ্রাস পাওয়া স্বাভাবিক মন্তব্য করে তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে নতুন কর্মসংস্থান তো দূরের কথা, বিদ্যমান কর্মীদের ধরে রাখাই কঠিন।
বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে দেশে ১৫২ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের প্রকৃত বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে। এর আগের বছর বিনিয়োগে পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫৯৯ কোটি ডলার। অর্থাৎ এফডিআই কমেছে।
জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনাইটেড ন্যাশন্স কনফারেন্স অন ট্রেড এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আঙ্কটাড)-এর তথ্য মতে, ২০১৩ সালে দেশে নিট বিনিয়োগ আসে ১৫৯ কোটি ৯১ লাখ ডলার। আর ২০১৪ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১৫২ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। আগের বছরের তুলনায় সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে চার দশমিক ৭৪ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৪ সালে দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মিলিয়ে মোট বৈদেশিক বিনিয়োগ আসে ২০৫ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। এসব তথ্য উঠে আসে গত ২৪ জুন রাজধানীতে আঙ্কটাড প্রকাশিত বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদন-২০১৫’ থেকে।
বিনিয়োগ সক্ষমতা হারাচ্ছে ব্যাংক
মধ্যবিত্তের আমানতের হার দিন দিন কমছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবিরতা, মূল্যস্ফীতি ও চলমান অবস্থায় মানুষ আর নতুন করে ব্যাংকে সঞ্চয় রাখতে পারছে না। পাশাপাশি বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। পরিচালনব্যয় কমানোর জন্য আমানতের সুদহার কমানো হচ্ছে। এতে কমে গেছে সার্বিক আমানতের প্রবৃদ্ধি। অর্থনীতির প্রধান প্রধান সূচক দিয়ে তৈরি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আর্থিক খাতে মোট আমানত সংগ্রহ করা হয়েছিল ৮৭ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। সমাপ্ত অর্থবছরে (২০১৪-১৫) তা কমে হয়েছে ৭৫ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। এক বছরে আমানত কমেছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বা সাড়ে ১৩ শতাংশ।
ব্যাংকারদের মতে, আমানত কমে গেলে বিনিয়োগের জন্য টাকার উৎস কমে যায়। এতে ব্যাংক আগের মতো বেশি পরিমাণ বিনিয়োগ করতে পারে না। কমে যায় ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ স্থবিরতা ও সর্বোপরি সুদহার কমে যাওয়ায় মানুষ ব্যাংকের আমানত ভেঙে ফেলছে। যার প্রভাব পড়ছে আমানতে। এটা অব্যাহত থাকলে ব্যাংকিং খাতসহ পুরো অর্থনীতির জন্য খারাপ সঙ্কেত বয়ে আনবে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে যখন স্থবিরতা নেমে আসে তখন তলবি আমানত নেতিবাচক হয়ে পড়ে। কারণ এ সময় ব্যবসায়ীরা আগের মতো লেনদেন করতে পারেন না। তাদের হাতে টাকা থাকে না। সবসময় ব্যবসায়ীরা টানাটানির মধ্যে থাকেন। আর মেয়াদি আমানত কমে যাওয়ার অর্থ হলো সাধারণ মানুষ আর আমানত রাখতে পারছেন না। মূল্যস্ফীতিই তাদের সঞ্চয় খেয়ে ফেলছে। তাদের মতে, মূল্যস্ফীতি দীর্ঘ দিন ধরে দুই অঙ্কের ঘরে অবস্থান করছে। আয়ের সাথে ব্যয় সঙ্কুলান করতে পারছে না নি¤œ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নির্ধারিত আয়ের মানুষ। এ কারণে এখন ভবিষ্যতের জন্য জমানো অর্থে হাত দিয়েছেন। মেয়াদপূর্তির আগেই ব্যাংকে জমানো স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ডিপিএস ভেঙে ফেলছে। সঞ্চয় ভেঙে খাওয়ায় কমে যাচ্ছে ব্যাংকগুলোর আমানত।
ব্যাংকে জমছে অলস টাকা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, বর্তমানে দেশের ব্যাংকগুলোর কাছে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার উদ্ধৃত্ত তারল্য রয়েছে। এর মধ্যে একেবারে অলস পড়ে আছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এসব নগদ অর্থ একসময় বাজারে বিনিয়োগকৃতই ছিল।
বাজারে অলস টাকার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৫ লাখ টাকা সুদ দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকের অলস টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার ভল্টে অলস রেখে দিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, টাকার প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ অলস অর্থের ব্যয়বহুল ব্যবস্থাপনায় নেমেছে। এজন্য গড়ে প্রতিদিন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ১৭ হাজার কোটি টাকা তুলে আনা হচ্ছে। এ টাকা কোনো উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার করা না হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে অলস ফেলে রাখা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নতুন কোনো বিনিয়োগই আসছে না। আর বিনিয়োগ না আসার কারণে ব্যাংকে অলস টাকার পরিমাণ বেড়ে চলছে। এ অলস টাকার কারণেই বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়েছে। এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্যই বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যয়বহুল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাজার থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। বিনিয়োগ মন্দার কারণে প্রতিটি ব্যাংকের হাতেই উদ্ধৃত্ত তহবিল রয়েছে। সাধারণত টাকার প্রবাহ বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর এ আশঙ্কা থেকেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অলস টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে অলস ফেলে রাখা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিল ও রিভার্স রেপোর মাধ্যমে এ টাকা তুলে নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গত এক মাসের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত জুলাই মাসে ১৮ কার্যদিবসে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে রিভার্স রেপোর মাধ্যমে তিন লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে, যা গড়ে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। এ টাকার বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে সুদ গুণতে হচ্ছে সোয়া ৫ শতাংশ হারে। ১ দিন থেকে ৩ তিন দিন মেয়াদি এ টাকা নেয়া হচ্ছে। ১৭ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে সোয়া ৫ শতাংশ সুদে গড়ে প্রতিদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সুদ গুণতে হচ্ছে প্রায় ২৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে ৫ জুলাই ২৩ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। ১ দিন থেকে ৩ দিন মেয়াদি এ টাকা তুলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে অলস ফেলে রাখা হচ্ছে। মাসের শেষ কার্যদিবস গত ৩০ জুলাই বৃহস্পতিবারও তুলে নেয়া হয়েছে ১৬ হাজার ১৯১ কোটি টাকা।
বিনিয়োগ থেকে আয় কমছে বাড়ছে ব্যয়
ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দুরবস্থা বিরাজ করছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ থেকে আয় কমলেও বাড়ছে ব্যয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, গত বছরে প্রতিষ্ঠানগুলোর পুঁজিবাজার, ট্রেজারি বিল, বন্ডসহ অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ থেকে আয় কমে নেমেছে ১২০ কোটি টাকায়, যেখানে আগের বছরে ছিল ১৬০ কোটি টাকা। কিন্তু পরিচালন ব্যয় বেড়ে হয়েছে ৫৫০ কোটি টাকা, যা আগের বছরে ছিল ৫৪০ কোটি।
এসব প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের কাছ থেকে আমানত নিচ্ছে। কিন্তু উদ্যোক্তার অভাবে তা বিনিয়োগ করতে পারছে না। এমনকি বিদ্যমান উদ্যোক্তাদেরও কম সুদে বিনিয়োগ দেখিয়ে ভাগিয়ে নিচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এমনি পরিস্থিতি মহাবিপাকে পড়েছে দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। অনেকেই নতুন উদ্যোক্তা খুঁজছেন। বাধ্য হয়ে বিকল্প বিনিয়োগের দিকে ছুটছে তারা। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ থেকে সরে এসে কেউ কেউ স্বল্প মেয়াদে বিনিয়োগ করার চেষ্টা করছেন।
আবার আমানত নিয়ে আমানত পরিশোধ করছে অনেক প্রতিষ্ঠান। নতুন করে বিনিয়োগ হচ্ছে না। ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের। এতে প্রতিষ্ঠানের আয় না বাড়লেও বিদ্যমান পরিচালন ব্যয় কমছে না, বরং ক্ষেত্রবিশেষ বেড়ে যাচ্ছে।
বিদেশী বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করবে
দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতির করুণ অবস্থার মধ্যেও গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। একইসঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা সমুন্নত রাখতে মূল্য বৃদ্ধির এ সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনার জোরালো দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ উদ্বেগ প্রকাশ করে ডিসিসিআই। বিবৃতিতে বলা হয়, মূল্য বৃদ্ধির এ সিদ্ধান্ত ব্যবসা-বাণিজ্যে নানামুখী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এর ফলে ব্যবসায় ব্যয় বৃদ্ধি পাবে এবং রফতানি বাধাগ্রস্ত হবে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ-এর মূল্য বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিটে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা কিনা অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হতে পারে।
ডিসিসিআই জানায়, বাংলাদেশের অর্থনীতির ধারাকে গতিশীল রাখার জন্য সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং ভবিষ্যতে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের এ দেশে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করবে। ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ব্যবহারের ফলে আমাদের টেক্সটাইল, তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য খাত ইতোমধ্যে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছে, তথাপি মূল্য বৃদ্ধির ফলে এ খাতগুলোর অগ্রগতির ধারা ব্যাহত হবে।
লন্ডনে রোড শো
এ দিকে বিনিয়োগে বিদেশীদের আকৃষ্ট করতে লন্ডনে দুদিনব্যাপী ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট রোড শো’-এর আয়োজন করেছে সরকার। ১০ সেপ্টেম্বর লন্ডনের ফিনান্সিয়াল ডিস্ট্রিক্ট ক্যানারি ওয়ার্ফের ইস্ট উইন্টার গার্ডেনে এই রোড শো শুরু হওয়ার কথা। আয়োজনে অংশ নেবেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর আতিউর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান এসএ সামাদ। বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী বিভিন্ন বিদেশী ব্যাংকের কর্মকর্তারাও এতে অংশ নেবেন।
ছয় বছরে ৫৭ লাখ মানুষ বাস্তুহারা
উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যা। গত ছয় বছরে বাংলাদেশের ৫৭ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন। এ তালিকার শীর্ষে রয়েছেন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। মূলত ঘূর্ণিঝড় ও আইলার কারণে এ অঞ্চলের মানুষ বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছেন। ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে শুধু বেড়িবাঁধ ভেঙেই আট লাখ ৪২ হাজার মানুষ প্রাথমিকভাবে বাস্তুহারা হয়ে পড়েছেন। পরে বেড়িবাঁধ মেরামত না করায় বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই।
যদিও বিশ্বে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। এ তালিকায় শীর্ষে রয়েছে চীন। এরপর রয়েছে ভারত, ফিলিপাইন, পাকিস্তান ও নাইজেরিয়া। গত ছয় বছরে বিশ্বে মোট বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যা দুই কোটি ৬৪ লাখ। এর মধ্যে ২০১৪ সালেই বিশ্বের এক কোটি ৯৩ লাখ মানুষ নতুন করে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এ হিসেবে প্রতি সেকেন্ডেই একজন করে মানুষ বাস্তুহারা হয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। মানুষের বাস্তুহারা হওয়ার এই ক্রমবর্ধমান পরিসংখ্যানে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জলবায়ুবিষয়ক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার ও নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল’-এর এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ছয়টি এলাকার মানুষ সবচেয়ে বেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে খুলনার দাকোপ, কয়রা ও বটিয়াঘাটা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এবং বাগেরহাটের মংলা উপজেলা রয়েছে। এ সব এলাকার মানুষ ঘূর্ণিঝড়ে সব হারিয়ে দেশের অন্যত্র চলে যান বা যেতে বাধ্য হন। পরে বাস্তুহারা এই মানুষের মধ্যে বেশির ভাগই আশ্রয় নেন ঢাকা, চট্টগ্রাম ও যশোর জেলায়। তবে অনেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতেও আশ্রয় নিয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বাস্তুচ্যুত হয়ে যারা অন্যত্র গেছেন, তারা আগের চেয়ে আরো খারাপ অবস্থায় রয়েছেন। জমিজমা না থাকায় পরিবারগুলোর মাসিক আয় কমে গেছে। এই বাস্তুচ্যুত মানুষের একাংশ চট্টগ্রামে পাহাড়ের ঢালে আশ্রয় নিয়ে আবারো দুর্যোগের কবলে পড়েছেন। এই মানুষগুলোর নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই, নেই নিজের কোনো ঘর। তারা বস্তুত রিকশা চালিয়ে বা ঠিকা শ্রমিকের কাজ করে বেঁচে আছেন।
সংস্থা দু’টির চলতি সালের ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালে বিশ্বের এক কোটি ৯৩ লাখ মানুষ নতুন করে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। আর গত ছয় বছরে মোট বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যা দুই কোটি ৬৪ লাখ। প্রতি সেকেন্ডেই একজন করে মানুষ তার বসতভিটা থেকে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন।