রুনা রহমানঃ সৃষ্টির রহস্য সুরের মূর্ছনায়। সুর যার আছে প্রকৃতি তাকে কাছে টানবেই। চাইলেও সে পারবেনা দূরে থাকতে। সুরের পাখিরা দিকে দিকে ছড়িয়ে দেয় তাদের সুরের লহমা, সুর সাগরে ত হয় স্নাত অগণিত শ্রোতা। শ্রোতা ও ভক্তের পুনঃপুন অনুরোধে যে সুর সাধিকা বাধ্য হয়েছেন মিডিয়া জগতে ফিরে আসতে, যার সুরে মূখরিত আমেরিকার অনেক স্টেটের মঞ্চ, কে – সে? তার কথা জানতে ইচ্ছে করছে, তাইতো!
বলছিলাম সুরের সাধিকা সায়েরা রেজা সম্পর্কে। যিনি দীর্ঘ দশ বছর দূরে ছিলেন মিডিয়া জগৎ থেকে। বিয়ের পর বাঙ্গালী নারীদের সমঝোতা করতে হয় নিজের ক্যারিয়ার ও পারিবারিক প্রয়োজনের সাথে! ৯৭ সালে বিয়ে হয় সায়েরার। বিয়ে মানেই দায়িত্ব, সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মিডিয়া থেকে দূরে থাকা। পৃথিবীতে আগমন ঘটেছে যার সুর সাধনার জন্য, চাইলেই কি সে পারে সঙ্গীত থেকে দূরে থাকতে?
সুরের সাথে খেলা করতে করতে যার বেড়ে ওঠা, মিডিয়া থেকে দূরে থাকলেও সুরের সাধনায় কোন ব্যাঘাত ঘটেনি তার। কারণ তার বিয়ে হয়েছে যে মানুষটির সাথে তিনি একজন সুরের পূজারি, যে সায়রাকে সার্বক্ষনিক সহযোগিতা করেছেন সুর সাধনায়। সেই পূজারির কর্মক্ষেত্র এমন এক পরিবেশে যেখানে একজন সুর সাধিকার মূল্যায়নে কোন কমতি নেই। তার স্বামী একজন উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা। প্রতিমাসে সেনা কমিউনিটির ক্লাবে রাতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় এবং সায়েরা রেজা সে সকল অনুষ্ঠানের মূখ্য শিল্পী হিসাবে গান পরিবেশন করে মাতিয়ে রাখেন সকলকে। তিনি সব ধরনের গান গেয়ে থাকেন। সায়েরার কণ্ঠ আর দশটা নারী শিল্পীদের মতো নয়। ব্যতিক্রমি কণ্ঠের অধিকারী হওয়ার দরুন বিশেষ কিছু গান তার কণ্ঠে আলাদা রকমের আবেদন তৈরী করে। সায়েরার কণ্ঠে লালন সঙ্গীত অনেক বেশী আবেদনময়ী।
শিশু একাডেমির সেই ছোট্ট মেয়েটির সৌভাগ্য হয়েছে আমেরিকার শহরের ‘মেট্রোপলিটন রুম’- ভেন্যুতে গান করার। এটি এমন একটি ভেন্যু যে কেউ চাইলেই এখানে গান পরিবেশন করতে পারেননা। আমেরিকার স্বনামধন্য এমন কোন শিল্পী নেই যারা এ ভেন্যুতে গান পরিবেশন করেননি। সায়েরা রেজা এবং তানভির শাহীন প্রথম কোন বাংলাদেশী শিল্পী, যারা প্রথম বাংলা ভাষায় এই ভেন্যুতে গান করলেন। তানভির শাহীন নিউ ইয়র্কে অবস্থান করছেন।
সায়েরা রেজা স্বামীর কর্মসূত্রে জাতিসংঘের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করারও সুযোগ পেয়েছেন। মুগ্ধ করেছেন ইউএন হেড কোয়ার্টারের টপ লেভেলের বিভিন্ন ভাষাভাষি বিশিষ্টজনদের।
জাতিসংঘ সদর দপ্তরের মধ্যে ২০১৪ সালের বার্ষিক গালা অনুষ্ঠানে সলো প্রোগ্রামে তিনি বাংলা, হিন্দী ও ইংরেজী তিনটি ভাষায় গান পরিবেশন করেন। সেই অনুষ্ঠানে রোজেন ক্রাসের গাওয়া ইংরেজী ভাষায় ‘৫০০ সরষব’ং’ গানটি পরিবেশন করেন, এই গানটি শুনে পেট্রা নামে একজন শ্রোতা কাঁদতে শুরু করেন। তিনি সায়েরাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তুমি কিভাবে এত দরদ দিয়ে এই গানটি গাইলে? এই গানের অর্থের সাথে আমার জীবনের অনেক মিল রয়েছে। এই খবরটি অনেক পত্র-পত্রিকা এবং মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছিল। সায়েরা রেজা সেদিন নিজেকে ধন্য মনে করেছিলেন, সার্থক হয়েছে তার সুরের সাধনা।
সায়েরা শিশু একাডেমিতে ৩ বছর তালিম নিয়েছেন। এরপর ফোক গানে নীনা হামিদ, ক্য¬াসিকেল ও রবীন্দ্র সঙ্গীতে ওস্তাদ সমীর চক্রবর্তী এবং আধুনিক ও পপ্ গানের জন্য পিলু মমতাজের কাছে তালিম নিয়েছেন। সায়েরা বিটিভি’র রবীন্দ্র সঙ্গীতের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। তিনি শুধু গানই করতেন না, গানের পাশাপাশি উপস্থাপনা করতেন। ‘অঙ্কুর’, ‘আমরা নতুন’ এবং শিক্ষা সম্পর্কিত ‘শিক্ষাঙ্গণ’ নামে বিটিভি’তে তিনটি অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা হিসাবে দীর্ঘ ৮ বছর উপস্থাপনা করেন তিনি। শিশু শিল্পী হিসাবে তার পদচারণা ছিল অবারিত। সেই তাকেই বিয়ের পর দূরে থাকতে হয়েছিল স্বপ্নের এ জগৎ থেকে।
২০০৬ সালে স্বামীর সাথে ইউকে-তে যান, সেখানে তিনি ইউকে-র দুটি বাংলা চ্যানেল এস টিভি এবং বাংলা টিভি-তে নিয়মিত গান করেন। বিশেষ করে এস টিভি-তে ‘সুর জলসা’ নামে একটি লাইভ প্রোগ্রামে তিনি নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। এ অনুষ্ঠানটি ৩/৪ ঘণ্টা ব্যাপী হতো। এ অনুষ্ঠানে তাকে বেশীর ভাগ সময়ই অনুরোধ করা হতো ফোক গান গাওয়ার জন্য। লালন গীতিতে তার যে আধিপত্য রয়েছে এটা স্বীকার করেছিলেন লালন স¤্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীন। সায়েরা রেজা তার প্রথম অ্যালবামে ফরিদা পারভীনের একটি গান পরিবেশন করার জন্য অনুমতি নিতে গেলে তার কণ্ঠ শুনে তিনি ও এ মন্তব্য করেছিলেন।
বিভিন্ন মঞ্চে যখন সায়েরা সঙ্গীত পরিবেশন করতেন, ভক্তরা বারবার তার কণ্ঠ শোনার জন্য একটা অ্যালবামের নাম, কোথায় কিনতে পাওয়া যাবে জানতে চাইতেন। তখনো তার কোন অ্যালবাম প্রকাশ হয়নি, তাই তিনি অনুভব করেছিলেন অ্যালবাম প্রকাশ করতে হবে। ২০০৭ সালে দেশে ফিরেই অ্যালবাম প্রকাশের উদ্দ্যোগ গ্রহণ করেন। তার প্রথম অ্যালবাম ‘সুখের অমিল’ প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে জি সিরিজ-এর ব্যানারে। এই অ্যালবামের একটি গান ‘ধার ধারি না পাড়া পড়শির, ধার ধারি না কারো’ সে সময়ের হাই সোল্ড ভিডিও ছিল। আজও এ গানের আবেদন ফুরিয়ে যায়নি। দ্বিতীয় অ্যালবাম প্রকাশ করেন লেজার ভিশন ‘এক নিমিষে’। সায়রার অর্জনের মধ্যে আরো রয়েছে ‘কমন জে-ার’ সিনেমার টাইটেল সং, ৯৬ সালে জাহিদ হাসানের বিপরীতে করেছেন প্যাকেজ নাটক ‘আমারো পরানো যাহা চায়’, ৮৮ সালে চম্পার ছোট বোন হিসাবে অভিনয় করেন ‘গর্জন’ সিনেমায়। এছাড়া লেখালেখির অভ্যাস তো ছিলই, আছেও।
২০১২ সালে সায়েরা রেজা স্ব-পরিবারে হজ্জ্ব করেন। হজ্জ্ব করার পর তিনি দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেন আর গান করতে পারবেন কিনা! বিভিন্ন ভাবে আলোচনা-পর্যালোচনা করে জানতে পারেন, ‘যে কোন শিক্ষা চর্চা করা যায় শালিনতার মাঝে। এখনও তিনি গান করছেন, দেশকে দেশের ভাষাকে তুলে ধরছেন অন্য ভাষাভাষির সামনে তার কণ্ঠের সুললিত মাধূর্য মিশিয়ে।
সায়েরা রেজা স্বামী, ছেলে রাফি রেজা আর মেয়ে অপ্সরা রেজাকে নিয়ে সম্প্রতি ঘুরে গেলেন দেশ থেকে। শিল্প-সাহিত্য প্রেমী এই দম্পতিদের নিউজার্সির বাড়ীর বেসমেন্টে তৈরী ষ্টুডিওতে প্রতিমাসে আড্ডা বসে ইউএন-এর ‘ঊনবাংগাল’ সাহিত্য সংগঠনের সদস্য কবি কাজী জহির, ফারুক আজম, হাসান ফেরদৌস, নিলুফার রেজা, তনিমা হাদীর পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে আগত যে কোন শিল্পী নিয়মিত আসেন এ আড্ডায়। সুর সাধনার জন্য ভিনদেশে তিনি একটা ষ্টুডিও তৈরী করেছেন যেন তার সুর সাধনায় কারো কোন সমস্যার সৃষ্টি না হয়। প্রবাসে বাংলাদেশীদের অনেক নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয় যে! গান রেওয়াজ করবার সময় প্রতিবেশীদের কারো যেন কোন সমস্যা না হয় সে জন্য তিনি প্রফেশনাল এ স্টুডিও তৈরী করেছেন। এখানে ৫০ জন এক সঙ্গে বসে আড্ডা দিতে পারে। স্বামীর সহযোগিতায় বাংলা গানের দূত হয়ে সায়েরা রেজা এগিয়ে যাবেন বলে শ্রোতারা মনে করেন।
ভিডিও দেখার জন্য এই লিংক ব্রাউজ করুন: Mujkurane ki Wajah – A Hindi Cover Song by Sayera Reza